ব্যারিস্টার পল্লব আচার্য…
অ্যাডভোকেট সুপ্রিম কোর্ট অফ বাংলাদেশ… আমাদের দেশের অধিকাংশ নাগরিক আইন, আদালত, বিচার শুনলেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পরে এমনকি আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। ছোটবেলায় যখন দেখতাম বড় বড় ফাইল আর বই নিয়ে বিজ্ঞ আইনজীবীগণ মামলা সম্পর্কে রেফারেন্স দিতেন বা ড্রাফটিং করতেন সত্যিই আমি অবাক হতাম। কৌতুহলী মন অনেক সময় জিজ্ঞেস করতে চাইতো কিভাবে সম্ভব কিন্তু সাহস করে উঠতাম না।
বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে আধুনিকতার ছোঁয়া সর্বস্তরে লেগেছে এবং আইন ও বিচার ব্যবস্থা তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে মনে করি Client Dealing এর ক্ষেত্রে আইনজীবী এবং তার ( Client ) মক্কেল উভয়ের স্বচ্ছতা প্রয়োজন। একজন ( Client ) মক্কেলের মাথায় রাখতে হবে আমরা আইনজীবীদের শেখানো হয় (to serve the best interest of each client with honesty and integrity)। আইনজীবীরা সব সময় চায় মাননীয় আদালতের মাধ্যমে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে এবং ক্লাইন্টের যথাযথ প্রতিকার নিশ্চিত করতে।
আমাদের দেশে মামলা জট রয়েছে এই কথা স্বীকার করতে আমার কোন আপত্তি নেই কিন্তু আমরা এই কথা কি কখনো ভেবেছি এই জটের কয়েকটি প্রধান কারণ এর মধ্যে একটি হলো মিথ্যা/ হয়রানির উদ্দেশ্য মামলা করা। কোন দেশ সঠিক গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক নিয়মে চলতে গেলে নাগরিক হিসেবে আমাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন হতে হবে।
একজন আইনজীবী এবং বিচারক সব সময় চেষ্টা করেন যত দ্রুত সম্ভব মামলা নিষ্পত্তি করতে। কোন রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন, শাসন ও বিচার ক্ষমতা পৃথক থাকলে সঠিকভাবে আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। চার্লস লুই দ্য মন্টেস্কু অষ্টাদশ শতকের একজন ফরাসি বিচারক ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক দার্শনিক এবং সমাজতত্ত্ববিদ তিনি বলেন আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বলতে বোঝায় রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন, শাসন ও বিচার ক্ষমতা পৃথক ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের হাতে অর্পণ করা যাতে এক বিভাগ অন্য বিভাগের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে। মন্টেস্কুর এই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ চিন্তা আধুনিক রাষ্ট্রধারণায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। পৃথিবীর বহু দেশ তাদের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই দর্শন কাজে লাগিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের খসড়া তৈরির ক্ষেত্রে মন্টেস্কুর রাষ্ট্রচিন্তা প্রভাবিত করেছিল। আমাদের দেশের সংবিধানেও আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ স্বতন্ত্ররূপে কাজ করবে এবং কেউ কাউকে হস্তক্ষেপ করবে না, বলা আছে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থার কথা আলাদাভাবেও সংবিধানে বলা আছে।
আইনগত প্রতিকার পাওয়া এটা আমাদের নাগরিক অধিকার তার জন্য আইন, আদালত এবং বিচার কিভাবে হবে তার ধারাবাহিক নিয়ম রয়েছে। কোন নাগরিকের অধিকার ক্ষুন্ন হলে তার বক্তব্য শোনার জন্য অন্য কোন বিভাগ না থাকলেও বিচার বিভাগ রয়েছে। নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব শুধু আদালতের শরণাপন্ন হওয়া, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ন্যায় বিচার পাওয়ার এর থেকে সহজ কোনো উপায় হতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ দ্বারা সকল নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে প্রত্যেকেই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অনুচ্ছেদ ৩১ উক্ত বিধানকে আরো শক্তিশালী করেছে এবং ৩৩ অনুচ্ছেদ ফৌজদারী বিষয়ে জনগণের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে।
এছাড়াও ১৯৪৮ সালের Universal Declaration of Human Rights (UDHR)-এ স্পষ্টভাবে বলা আছে যে, সকল মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং কোনো বৈষম্য ব্যতিরেকে প্রত্যেকেই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। উক্ত ঘোষণায় আরো বলা হয়েছে, কাউকে খেয়াল খুশিমত গ্রেফতার বা আটক করা যাবে না এবং নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য শুনানীর মাধ্যমে উপযুক্ত আদালত কর্তৃক বিচার পাওয়ার অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির থাকবে।
এমনকি কোন অসচ্ছল ব্যক্তি মামলা পরিচালনায় অসমর্থ হলে তাকে The Legal Aid Act 2000 মাধ্যমে সহায়তা দেয়া হবে এবং এই আইনের ২ নং ধারা অনুযায়ী আইনগত সহায়তা বলতে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল, সহায় সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচার প্রার্থীকে আইনগত পরামর্শ প্রদান, আইনজীবীর ফিস প্রদান ও মামলার খরচ প্রদানসহ অন্য যে কোন সহায়তা প্রদান বুঝাবে।
বিচার প্রার্থীদের সকল ধরনের সহায়তার দ্বার সবসময় খোলা থাকে শুধুমাত্র সচেতনতা ও অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অনেকে হয়রানি শিকার হচ্ছে। প্রত্যেক বিচার প্রার্থী যদি সচেতন হয় তাহলে আমি মনে করি হয়রানি বন্ধ হবে এবং বাংলাদেশে মামলা জট অনেকাংশে কমে আসবে।